পাইলস কেন ও কাদের হয়, অপারেশন ছাড়া কি চিকিৎসা আছে
ভূমিকা
পাইলস বা অর্শ্বরোগ এমন একটি স্বাস্থ্য সমস্যা, যা বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে অসংখ্য মানুষকে ভোগাচ্ছে। মলদ্বারের ভেতরের শিরায় অতিরিক্ত চাপ পড়লে শিরাগুলো ফুলে উঠে এবং ফোলা অবস্থায় ব্যথা, জ্বালা ও রক্তপাতের মতো অস্বস্তিকর উপসর্গ দেখা দেয়। সাধারণভাবে অনেকেই মনে করেন পাইলস হলে অপারেশন ছাড়া উপায় নেই, কিন্তু আসলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জীবনযাত্রা পরিবর্তন, ওষুধ এবং নন-সার্জিকাল চিকিৎসার মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। এই প্রবন্ধে আমরা জানব—পাইলস কেন হয়, কারা বেশি আক্রান্ত হন এবং অপারেশন ছাড়াও কীভাবে কার্যকর চিকিৎসা সম্ভব।
পাইলস কী?
পাইলস হলো মলদ্বার বা রেক্টামের শিরা ফুলে যাওয়া। এ সময় টিস্যুতে প্রদাহ সৃষ্টি হয় এবং ফোলাভাব বাড়তে থাকে। পাইলস দুই ধরনের হতে পারে:
-
ইন্টারনাল পাইলস (ভেতরের অর্শ্বরোগ): রেক্টামের ভেতরে হয়, সাধারণত ব্যথা কম হয় কিন্তু রক্তপাত হতে পারে।
-
এক্সটারনাল পাইলস (বাহ্যিক অর্শ্বরোগ): মলদ্বারের বাইরে হয়, এতে ব্যথা, চুলকানি এবং ফোলা বেশি দেখা দেয়।
পাইলস হওয়ার কারণ
পাইলস হওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান হলো—
-
দীর্ঘদিনের কোষ্ঠকাঠিন্য: শক্ত মল বের করতে অতিরিক্ত চাপ দিতে হয়, যা শিরায় চাপ সৃষ্টি করে।
-
ডায়রিয়া বা পাতলা পায়খানা দীর্ঘদিন থাকা: এতে শিরায় টান ধরে এবং প্রদাহ দেখা দেয়।
-
গর্ভাবস্থা: গর্ভবতী নারীদের শরীরে অতিরিক্ত চাপ পড়ে বলে পাইলসের ঝুঁকি বাড়ে।
-
ওজনাধিক্য ও স্থূলতা: শরীরের বাড়তি ওজন সরাসরি মলদ্বারের শিরায় চাপ ফেলে।
-
দীর্ঘ সময় বসে থাকা: অফিস বা গাড়ি চালানোর মতো কাজের কারণে পাইলসের ঝুঁকি বেশি।
-
বয়স বৃদ্ধি: বয়স বাড়ার সাথে সাথে শিরাগুলো দুর্বল হয়ে যায়।
-
ভারী ওজন তোলা বা শারীরিক শ্রম: হঠাৎ ভারী কিছু তোলার ফলে শিরা ফেটে গিয়ে পাইলস হতে পারে।
কারা বেশি ঝুঁকিতে
-
যাদের খাদ্যতালিকায় আঁশ কম
-
যারা পর্যাপ্ত পানি খান না
-
অফিসে দীর্ঘ সময় বসে কাজ করেন
-
গর্ভবতী নারী
-
যাদের পরিবারে পাইলসের ইতিহাস আছে
-
স্থূল বা অতিরিক্ত ওজনের মানুষ
পাইলসের উপসর্গ
পাইলসের মাত্রা ও ধরণ অনুযায়ী উপসর্গ ভিন্ন হয়। সাধারণত দেখা যায়—
-
মলত্যাগের সময় রক্তপাত
-
মলদ্বারে ব্যথা বা জ্বালা
-
মলদ্বারের চারপাশে চুলকানি
-
বসতে কষ্ট হওয়া
-
মলদ্বারে ফোলা বা গুটির মতো অনুভূতি
অপারেশন ছাড়া পাইলসের চিকিৎসা
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রাথমিক অবস্থায় পাইলসের চিকিৎসা অপারেশন ছাড়াই সম্ভব। নিচে ধাপে ধাপে উপায়গুলো দেওয়া হলো।
১. খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন
-
বেশি করে আঁশযুক্ত খাবার (ডাল, শাকসবজি, ফল, গোটা শস্য) খেতে হবে।
-
প্রতিদিন কমপক্ষে ২–৩ লিটার পানি পান করতে হবে।
-
ঝাল, তেল-চর্বি ও প্রক্রিয়াজাত খাবার কম খেতে হবে।
২. জীবনযাত্রার পরিবর্তন
-
দীর্ঘ সময় বসে না থেকে বিরতি নিয়ে হাঁটাচলা করা।
-
টয়লেটে অযথা বেশি সময় না কাটানো।
-
ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা।
-
নিয়মিত হালকা ব্যায়াম করা।
৩. ওষুধ ও মলম
ডাক্তাররা প্রাথমিক অবস্থায় পেইন রিলিভার, অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি ওষুধ বা সাপোসিটরি ব্যবহার করতে বলেন। কিছু মলম বা ক্রিম মলদ্বারের জ্বালা ও চুলকানি কমাতে সহায়তা করে।
৪. সিটজ বাথ
গরম পানিতে দিনে কয়েকবার ১০–১৫ মিনিট বসে থাকা উপসর্গ উপশমে কার্যকর।
৫. নন-সার্জিকাল চিকিৎসা পদ্ধতি
আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে বেশ কিছু সহজ ও নিরাপদ উপায় আছে—
-
রাবার ব্যান্ড লিগেশন: পাইলসের গোড়ায় রাবার ব্যান্ড বেঁধে দেওয়া হয়। এতে রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে গুটি শুকিয়ে যায়।
-
ইনজেকশন থেরাপি (স্ক্লেরোথেরাপি): বিশেষ ওষুধ ইনজেকশন দিয়ে শিরাগুলো সঙ্কুচিত করা হয়।
-
ইনফ্রারেড কোয়াগুলেশন: লেজার বা তাপের মাধ্যমে ক্ষত টিস্যু শুকিয়ে ফেলা হয়।
-
ডপলার গাইডেড হেমোরয়েডাল আর্টারি লিগেশন: আধুনিক পদ্ধতিতে রক্তনালী সঠিকভাবে বেঁধে দেওয়া হয়।
কবে অপারেশন প্রয়োজন?
যদি পাইলস অত্যন্ত বড় হয়, রক্তপাত অনেক বেশি হয় বা অন্য কোনো উপায়ে নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তখন সার্জারি প্রয়োজন হতে পারে। তবে রোগীর অবস্থা অনুযায়ী সার্জারি করার সিদ্ধান্ত নেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।
প্রতিরোধের উপায়
-
নিয়মিত আঁশযুক্ত খাবার খাওয়া
-
প্রতিদিন পর্যাপ্ত পানি পান করা
-
দীর্ঘ সময় বসে না থাকা
-
প্রতিদিন হালকা ব্যায়াম করা
-
মলত্যাগের সময় চাপ না দেওয়া
-
ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা
উপসংহার
পাইলস একটি সাধারণ কিন্তু অস্বস্তিকর সমস্যা। অনেকেই মনে করেন এর একমাত্র সমাধান অপারেশন, কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সঠিক খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম, ওষুধ এবং আধুনিক নন-সার্জিকাল চিকিৎসার মাধ্যমে পাইলস নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। তাই উপসর্গ দেখা দিলে ভয় না পেয়ে দ্রুত বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।