ডায়াবেটিক রোগীর পায়ের যত্নে যা করতে হবে
ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকিগুলোর একটি হলো পায়ের জটিলতা। অনেক সময় ক্ষুদ্র একটি কাটা, ফোস্কা কিংবা সংক্রমণ থেকে শুরু হয় বড় সমস্যা, যা শেষ পর্যন্ত পা কেটে ফেলতে পর্যন্ত বাধ্য করতে পারে। গবেষণা বলছে, বিশ্বজুড়ে ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের প্রায় ১৫-২০ শতাংশ জীবনে কোনো না কোনো সময় পায়ের গুরুতর সমস্যায় ভোগেন। অথচ নিয়মিত যত্ন ও সচেতনতা থাকলে এই ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো যায়। তাই ডায়াবেটিক রোগীর জন্য পায়ের যত্ন নেওয়া শুধু গুরুত্বপূর্ণই নয়, এটি জীবন রক্ষারও অংশ।
কেন ডায়াবেটিস রোগীর পায়ের যত্ন জরুরি?
ডায়াবেটিস রোগীর শরীরে রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিকের তুলনায় কমে যায়। এর ফলে পায়ের ক্ষত দ্রুত শুকাতে চায় না। একই সঙ্গে অনেক রোগীর স্নায়ুর কার্যক্ষমতা কমে গিয়ে পায়ে অসাড়ভাব সৃষ্টি হয়, ফলে ছোটখাটো আঘাত টের পান না। এই পরিস্থিতিতে—
-
সামান্য কাটা বা ফোস্কা থেকে ইনফেকশন হতে পারে।
-
ইনফেকশন ছড়িয়ে গ্যাংগ্রিন পর্যন্ত হতে পারে।
-
অবহেলা করলে অঙ্গ কেটে ফেলতে হতে পারে।
এ কারণে ডাক্তাররা বারবার পরামর্শ দেন, ডায়াবেটিক রোগীরা যেন বিশেষভাবে তাদের পায়ের যত্ন নেন।
প্রতিদিন পা পরীক্ষা করার অভ্যাস
ডায়াবেটিক রোগীর পায়ের যত্নে সবচেয়ে প্রথম করণীয় হলো প্রতিদিন পা পরীক্ষা করা।
-
পায়ের আঙুল, তলা, গোড়ালি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
-
কোনো কাটা, ফোস্কা, ফাটা, লালচে দাগ বা কালো দাগ আছে কি না খেয়াল করতে হবে।
-
চোখে দেখতে অসুবিধা হলে পরিবারের সদস্যের সাহায্য নিতে হবে, অথবা আয়না ব্যবহার করতে হবে।
এভাবে নিয়মিত পরীক্ষা করলে সমস্যা প্রথম পর্যায়েই ধরা পড়ে এবং দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া সম্ভব হয়।
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা
ডায়াবেটিক রোগীর জন্য পা পরিষ্কার ও শুকনো রাখা অত্যন্ত জরুরি।
-
প্রতিদিন হালকা গরম পানিতে পা ধুতে হবে।
-
সাবান ব্যবহার করা যেতে পারে, তবে শক্তিশালী রাসায়নিক সাবান নয়।
-
ধোয়ার পর নরম তোয়ালে দিয়ে আলতোভাবে শুকিয়ে নিতে হবে।
-
বিশেষ করে আঙুলের ফাঁক শুকনো রাখতে হবে, কারণ সেখানেই ছত্রাক সংক্রমণ হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।
সঠিক জুতা ও মোজা ব্যবহার
ডায়াবেটিক রোগীর পায়ের যত্নে জুতার ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
-
আঁটসাঁট বা শক্ত জুতা ব্যবহার করা যাবে না।
-
সবসময় নরম ও আরামদায়ক জুতা পরতে হবে, যাতে পায়ের তলায় চাপ কম পড়ে।
-
খালি পায়ে হাঁটা এড়িয়ে চলা জরুরি।
-
মোজা সবসময় পরিষ্কার রাখতে হবে এবং সুতির মোজা ব্যবহার করা ভালো।
নখ কাটা ও পরিচর্যা
নখের ভুল যত্ন থেকেও পায়ের সমস্যা বাড়তে পারে।
-
নখ সবসময় সোজা করে কাটতে হবে।
-
খুব ছোট করে বা কোণা কেটে ফেলা যাবে না।
-
ইনগ্রোন নখ হলে ঘরে বসে চিকিৎসা না করে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
নিয়মিত চিকিৎসকের কাছে যাওয়া
পায়ের সমস্যা প্রতিরোধে নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
-
বছরে অন্তত একবার ডাক্তার বা পডিয়াট্রিস্ট দিয়ে পায়ের পূর্ণাঙ্গ পরীক্ষা করাতে হবে।
-
কারও পায়ে আগে থেকেই আলসার বা ইনফেকশনের ইতিহাস থাকলে আরও ঘন ঘন পরীক্ষা প্রয়োজন।
-
কোনো ক্ষত হলে ঘরোয়া চিকিৎসার চেষ্টা না করে দ্রুত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
পায়ের জন্য করণীয় সতর্কতা
-
খুব গরম পানি বা বরফে সরাসরি পা ডুবিয়ে রাখা যাবে না।
-
ক্ষত ঢাকতে কখনোই শক্ত প্লাস্টার ব্যবহার করা উচিত নয়।
-
রক্ত সঞ্চালন সচল রাখতে প্রতিদিন হালকা ব্যায়াম করা যেতে পারে।
-
সিগারেট ও অ্যালকোহল পরিহার করতে হবে, কারণ এগুলো রক্ত সঞ্চালন কমিয়ে দেয়।
সুষম খাদ্য ও সুস্থ জীবনযাপন
পায়ের যত্ন শুধু বাইরের পরিচর্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার মাধ্যমেই পায়ের সমস্যা অনেকাংশে এড়ানো যায়।
-
নিয়মিত রক্তে শর্করার মাত্রা পরীক্ষা করতে হবে।
-
ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী খাবার খেতে হবে।
-
শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
-
পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও ঘুম নিশ্চিত করতে হবে।
কেন সচেতনতা সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ?
বিশ্বে প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ ডায়াবেটিক ফুট জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে অঙ্গ হারান। অথচ সামান্য সচেতনতা ও নিয়মিত যত্ন নিলে এই ভয়াবহ অবস্থা থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। মনে রাখতে হবে, ডায়াবেটিক রোগীর পায়ের ক্ষুদ্র আঘাতও অবহেলার সুযোগ নেই।
উপসংহার
ডায়াবেটিক রোগীর পায়ের যত্ন মানেই সচেতনতা, নিয়মিত পরীক্ষা ও সঠিক পরিচর্যা। প্রতিদিন পা দেখা, পরিষ্কার রাখা, সঠিক জুতা ব্যবহার, নখের যত্ন, নিয়মিত ডাক্তার দেখানো এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখলে গুরুতর জটিলতা অনেকাংশে এড়ানো যায়। তাই বলা যায়, ডায়াবেটিক রোগীর পায়ের যত্ন নেওয়া মানেই সুস্থ জীবনের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।