ক্যালসিয়াম ঘাটতির কারণ ও লক্ষণ
মানবদেহে ক্যালসিয়াম একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খনিজ উপাদান। এটি কেবল হাড় ও দাঁতের গঠনে নয়, বরং হৃদপিণ্ড, স্নায়ুতন্ত্র এবং পেশির কার্যক্রমেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস, প্রক্রিয়াজাত খাবারের আধিক্য এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তনের কারণে ক্যালসিয়াম ঘাটতির ঝুঁকি বেড়েছে উদ্বেগজনকভাবে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশে এখন প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ ক্যালসিয়াম ঘাটতিতে ভুগছেন। এই ঘাটতি ধীরে ধীরে শরীরের ভেতরে এমন প্রভাব ফেলে, যা প্রথমে বুঝতে না পারলেও সময়ের সঙ্গে ভয়াবহ আকার ধারণ করে।
ক্যালসিয়ামের ভূমিকা শরীরে
ক্যালসিয়াম শুধু হাড়ের জন্য নয়, এটি রক্ত জমাট বাঁধা, স্নায়ু সঞ্চালন, পেশি সংকোচন এবং হৃদপিণ্ডের কার্যকারিতার জন্য অপরিহার্য।
প্রধান কাজগুলো হলো:
-
হাড় ও দাঁত মজবুত রাখে
-
রক্ত জমাট বাঁধতে সহায়তা করে
-
স্নায়ু সংকেত প্রেরণ নিয়ন্ত্রণ করে
-
পেশি সংকোচন স্বাভাবিক রাখে
-
হরমোন নিঃসরণে সহায়তা করে
বিশেষজ্ঞদের মতে, দৈনিক একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির ১০০০–১২০০ মি.গ্রা. ক্যালসিয়াম প্রয়োজন। গর্ভবতী নারী ও বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে এই প্রয়োজন আরও বেড়ে যায়।
ক্যালসিয়াম ঘাটতির প্রধান কারণ
সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এবং ভিটামিন-ডি ঘাটতিই ক্যালসিয়াম ঘাটতির সবচেয়ে বড় কারণ।
খাদ্যাভ্যাসজনিত কারণ
অতিরিক্ত চা, কফি, সফট ড্রিংক ও ফাস্টফুড গ্রহণ ক্যালসিয়ামের শোষণ কমায়।
দুধ, ডিম, মাছ ও সবুজ শাকসবজি না খাওয়াও অন্যতম কারণ।
সূর্যালোকের অভাব
ভিটামিন-ডি ক্যালসিয়াম শোষণে সাহায্য করে, কিন্তু পর্যাপ্ত সূর্যালোক না পেলে শরীরে ভিটামিন-ডি উৎপাদন কমে যায়।
হরমোন ও ওষুধের প্রভাব
-
দীর্ঘদিন স্টেরয়েড সেবন
-
থাইরয়েড বা প্যারাথাইরয়েড সমস্যা
-
কিডনি রোগ
এসব কারণেও শরীরে ক্যালসিয়াম শোষণ ব্যাহত হয়।
ক্যালসিয়াম ঘাটতির লক্ষণ
প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যালসিয়াম ঘাটতি বোঝা যায় না। তবে কিছু সতর্ক সংকেত আছে যা উপেক্ষা করা উচিত নয়।
সাধারণ লক্ষণগুলো হলো:
-
ঘন ঘন হাড়ে ব্যথা বা দুর্বলতা
-
দাঁতের ক্ষয় ও মাড়ির সমস্যা
-
ত্বক শুষ্ক হয়ে যাওয়া
-
হাত-পায়ের অবশ ভাব
-
হৃদস্পন্দন অনিয়মিত হওয়া
-
রাতে পেশি টান ধরা
দীর্ঘমেয়াদে এই ঘাটতি অস্টিওপোরোসিস, হাড় ভাঙার ঝুঁকি, এমনকি স্নায়বিক জটিলতাও তৈরি করতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ
ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) পুষ্টিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ডা. সায়মা রহমান বলেন,
“আমাদের দেশে ক্যালসিয়াম ঘাটতি বাড়ছে কারণ মানুষ দুধ ও প্রাকৃতিক খাবারের পরিবর্তে প্রক্রিয়াজাত খাবারে ঝুঁকছে। সূর্যালোক এড়িয়ে চলা এবং অল্প বয়স থেকেই ভিটামিন ঘাটতি দেখা দিচ্ছে।”
তিনি আরও জানান, নিয়মিত দুধ, মাছ, ডিম, ডাল, শাকসবজি খাওয়া এবং প্রতিদিন অন্তত ১৫ মিনিট সূর্যের আলোয় থাকা অত্যন্ত জরুরি।
কোন খাবারে ক্যালসিয়াম বেশি
বিশেষজ্ঞদের মতে, নিচের খাবারগুলো নিয়মিত গ্রহণ করলে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি পূরণ সম্ভব —
-
দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য (দই, পনির)
-
ছোট মাছ (বিশেষ করে শুঁটকি, ইলিশ, কাঁচকি)
-
সবুজ শাকসবজি (লাল শাক, পালং শাক, কলমিশাক)
-
বাদামজাতীয় খাবার (আমন্ড, তিল, চিনাবাদাম)
-
ডিমের কুসুম ও সয়াবিন
এছাড়াও সন্তুলিত খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম ও পর্যাপ্ত পানি পান শরীরে খনিজ ভারসাম্য রক্ষা করে।
কারা সবচেয়ে ঝুঁকিতে
গবেষণায় দেখা গেছে কিছু জনগোষ্ঠী তুলনামূলক বেশি ঝুঁকিতে আছেন:
-
গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী নারী
-
বয়স্ক নারী (৪৫ বছরের বেশি)
-
শিশু ও কিশোর
-
দীর্ঘ সময় অফিসে বসে থাকা কর্মজীবী
-
যারা নিয়মিত চা-কফি বেশি খান
ক্যালসিয়াম ঘাটতি প্রতিরোধের উপায়
১. সুষম খাদ্য গ্রহণ করুন
প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় দুধ, শাকসবজি ও প্রোটিন রাখুন।
২. সূর্যের আলো গ্রহণ করুন
ভোর বা বিকেলে অন্তত ১৫–২০ মিনিট বাইরে থাকুন।
৩. অতিরিক্ত ক্যাফেইন এড়িয়ে চলুন
অতিরিক্ত কফি বা সফট ড্রিংক ক্যালসিয়াম ক্ষয় করে।
৪. নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করুন
রক্তে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন-ডি মাত্রা পরীক্ষা করা জরুরি।
চিকিৎসা ও পরিপূরক ব্যবহার
যদি ঘাটতি বেশি হয়, চিকিৎসকরা ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট দিতে পারেন। তবে এটি নিজে থেকে গ্রহণ করা বিপজ্জনক, কারণ অতিরিক্ত ক্যালসিয়াম কিডনিতে পাথর তৈরি করতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দেন—
-
চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সাপ্লিমেন্ট ব্যবহার করুন
-
প্রাকৃতিক উৎস থেকে ক্যালসিয়াম নেওয়াই সর্বোত্তম
ক্যালসিয়াম ঘাটতির দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব
যদি ঘাটতি দীর্ঘ সময় স্থায়ী হয়, তবে—
-
হাড় পাতলা হয়ে যায় (অস্টিওপোরোসিস)
-
দাঁত দুর্বল ও ভঙ্গুর হয়
-
নার্ভ সিস্টেমে সমস্যা হয়
-
হৃদপিণ্ডে অনিয়মিততা দেখা দেয়
এছাড়া গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে শিশুর হাড়ের গঠনে গুরুতর প্রভাব পড়ে।
উপসংহার
ক্যালসিয়াম ঘাটতি একটি নীরব স্বাস্থ্য সমস্যা, যা ধীরে ধীরে শরীরের প্রতিটি অংশে প্রভাব ফেলে। সচেতনতা ও সঠিক খাদ্যাভ্যাসই এর প্রতিরোধের মূল চাবিকাঠি।
আজ থেকেই যদি আপনি দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ খাবার যুক্ত করেন এবং নিয়মিত সূর্যালোক গ্রহণ করেন, তাহলে সহজেই এই ঝুঁকি থেকে দূরে থাকা সম্ভব।
অন্য খবর বিডিও দেখতে ভিজিট করুন…………
🌐 ওয়েবসাইট: Shobkhobor24 https://www.shobkhobor24.com
🎥 ইউটিউব: Shobkhobor24 YouTube https://www.youtube.com/@shobkhobor24
📘 ফেসবুক: Shobkhobor24 Facebook https://www.facebook.com/profile.php?id=61578376864291