হৃদরোগ : সময়মতো চিকিৎসাই বাঁচাতে পারে প্রাণ
ভূমিকা
বিশ্বজুড়ে মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হলো হৃদরোগ। বিশেষজ্ঞদের মতে, সঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু করলে এবং জীবনযাপনে পরিবর্তন আনলে হৃদরোগজনিত মৃত্যুর হার অনেকটাই কমানো সম্ভব। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে হৃদরোগীর সংখ্যা। কাজেই সচেতনতা বাড়ানো, প্রাথমিক চিকিৎসা গ্রহণ এবং জীবনযাপন নিয়ন্ত্রণ করা এখন সময়ের দাবি।
হৃদরোগ কী?
হৃদরোগ হলো হৃদপিণ্ডের যেকোনো অসুস্থতা বা অকার্যকারিতা। সাধারণভাবে হৃদরোগ বলতে বোঝানো হয় –
-
করোনারি হার্ট ডিজিজ (ধমনিতে ব্লক হওয়া),
-
হার্ট অ্যাটাক,
-
হার্ট ফেইলিউর,
-
অ্যারিদমিয়া (হৃদস্পন্দনের অসামঞ্জস্যতা),
-
কার্ডিওমায়োপ্যাথি প্রভৃতি।
হৃদপিণ্ড শরীরের প্রতিটি কোষে অক্সিজেনসমৃদ্ধ রক্ত সরবরাহ করে। এই প্রক্রিয়ায় সমস্যা হলে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পর্যাপ্ত রক্ত পায় না, ফলে জীবন হুমকির মুখে পড়ে।
হৃদরোগের প্রধান কারণ
হৃদরোগ হওয়ার নানা কারণ রয়েছে। সবচেয়ে সাধারণ কারণগুলো হলো –
-
অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস – অতিরিক্ত চর্বি, লবণ, ভাজা খাবার ও জাঙ্ক ফুড খাওয়া।
-
উচ্চ রক্তচাপ (Hypertension) – দীর্ঘমেয়াদে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে না থাকলে হৃদপিণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
-
ডায়াবেটিস – শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে না থাকলে হৃদরোগের ঝুঁকি দ্বিগুণ হয়।
-
ধূমপান ও অ্যালকোহল – নিকোটিন ও অ্যালকোহল হৃদপিণ্ডের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
-
স্থূলতা ও অতিরিক্ত ওজন – শরীরে চর্বি জমে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
-
শারীরিক পরিশ্রমের অভাব – ব্যায়াম না করলে রক্ত সঞ্চালন দুর্বল হয়।
-
বংশগত কারণ – পরিবারে কারও হৃদরোগ থাকলে ঝুঁকি বেশি থাকে।
-
মানসিক চাপ – অতিরিক্ত স্ট্রেস ও টেনশনও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
হৃদরোগের লক্ষণ
হৃদরোগের লক্ষণ দ্রুত চিহ্নিত করা অত্যন্ত জরুরি। সাধারণ লক্ষণগুলো হলো –
-
বুকে চাপ বা ব্যথা
-
শ্বাসকষ্ট
-
মাথা ঘোরা বা দুর্বল লাগা
-
ঘাম হওয়া
-
বাহু, পিঠ, ঘাড় বা চোয়ালে ব্যথা
-
অনিয়মিত হৃদস্পন্দন
বিশেষ সতর্কতা: অনেক সময় মহিলাদের হৃদরোগের লক্ষণ পুরুষদের তুলনায় ভিন্ন হয়। যেমন – অস্বাভাবিক ক্লান্তি, বমিভাব, হজমের সমস্যা ইত্যাদি।
সময়মতো চিকিৎসার গুরুত্ব
হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার পর কয়েক মিনিটই নির্ধারণ করে দেয় জীবন-মৃত্যু। চিকিৎসকরা বলেন, “গোল্ডেন আওয়ার” বা আক্রান্ত হওয়ার প্রথম এক ঘণ্টার মধ্যে চিকিৎসা শুরু করলে মৃত্যুর ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়।
সময়মতো চিকিৎসা না করলে –
-
হার্টের পেশি স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
-
ভবিষ্যতে হার্ট ফেইলিউর হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
-
মৃত্যুর সম্ভাবনা কয়েকগুণ বেড়ে যায়।
হৃদরোগ নির্ণয়ের উপায়
হৃদরোগ দ্রুত চিহ্নিত করতে বিভিন্ন পরীক্ষা করা হয়। যেমন –
-
ইসিজি (ECG) – হৃদস্পন্দনের অনিয়ম ধরতে সাহায্য করে।
-
ইকোকার্ডিওগ্রাম – হৃদপিণ্ডের গঠন ও কার্যক্ষমতা দেখা যায়।
-
ট্রপোনিন টেস্ট – হার্ট অ্যাটাকের সময় রক্তে এনজাইমের মাত্রা বেড়ে যায়।
-
এঞ্জিওগ্রাম – ধমনিতে ব্লক আছে কিনা তা নির্ণয় করে।
-
স্ট্রেস টেস্ট – শারীরিক পরিশ্রমে হৃদপিণ্ডের কার্যক্ষমতা দেখা হয়।
হৃদরোগের চিকিৎসা
ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা
-
রক্ত পাতলা করার ওষুধ (Aspirin, Clopidogrel)
-
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের ওষুধ
-
কোলেস্টেরল কমানোর ওষুধ (Statins)
-
বিটা-ব্লকার, এন্টি-অ্যারিদমিক ওষুধ
সার্জারি বা বিশেষ চিকিৎসা
-
এঞ্জিওপ্লাস্টি ও স্টেন্টিং – ব্লক খুলে স্টেন্ট বসানো।
-
বাইপাস সার্জারি – ক্ষতিগ্রস্ত ধমনিকে বাইপাস করে নতুন পথ তৈরি করা।
-
পেসমেকার বসানো – অনিয়মিত হৃদস্পন্দন নিয়ন্ত্রণে রাখতে।
-
হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট – গুরুতর ক্ষেত্রে নতুন হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপন।
হৃদরোগ প্রতিরোধে করণীয়
হৃদরোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব যদি সচেতনতা তৈরি হয় এবং নিয়ম মেনে চলা হয়। কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ –
-
সুষম খাদ্য গ্রহণ করুন – বেশি করে শাকসবজি, ফলমূল, ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ মাছ খান।
-
নিয়মিত ব্যায়াম করুন – প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটা বা হালকা ব্যায়াম করুন।
-
ধূমপান ও অ্যালকোহল ত্যাগ করুন।
-
ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন।
-
রক্তচাপ ও শর্করা পরীক্ষা করুন নিয়মিত।
-
স্ট্রেস ম্যানেজ করুন – মেডিটেশন, যোগব্যায়াম বা প্রার্থনা কাজে দেয়।
-
পর্যাপ্ত ঘুমান – প্রতিদিন অন্তত ৭-৮ ঘণ্টা ঘুম জরুরি।
-
নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করুন – বছরে অন্তত একবার হৃদপিণ্ড পরীক্ষা করা উচিত।
বাংলাদেশে হৃদরোগের বর্তমান অবস্থা
বাংলাদেশে প্রতিবছর কয়েক লাখ মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়। শহরাঞ্চলে জাঙ্ক ফুড, মানসিক চাপ ও ধূমপানের কারণে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বেশি। গ্রামাঞ্চলেও খাদ্যাভ্যাস ও ডায়াবেটিসের কারণে সমস্যা বাড়ছে।
বাংলাদেশ কার্ডিওলজি সোসাইটির তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর প্রায় ২ লক্ষাধিক মানুষ হৃদরোগে মারা যায়। এ সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
সচেতনতার প্রয়োজন
হৃদরোগ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা জরুরি।
-
স্কুল-কলেজে স্বাস্থ্য শিক্ষা চালু করা উচিত।
-
গণমাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধির প্রচারণা চালাতে হবে।
-
পরিবার থেকেই খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনা দরকার।
-
জরুরি চিকিৎসা সুবিধা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও পৌঁছে দিতে হবে।
উপসংহার
হৃদরোগ একটি নীরব ঘাতক। তবে সময়মতো চিকিৎসা, জীবনধারার পরিবর্তন এবং সচেতনতা হৃদরোগের ঝুঁকি অনেকাংশে কমাতে পারে। মনে রাখবেন, “প্রতিরোধ চিকিৎসার চেয়ে ভালো”। তাই এখন থেকেই সুস্থ জীবনযাপন শুরু করা উচিত।
অন্য খবর বিডিও দেখতে ভিজিট করুন…………
🌐 ওয়েবসাইট: Shobkhobor24 https://www.shobkhobor24.com
🎥 ইউটিউব: Shobkhobor24 YouTube https://www.youtube.com/@shobkhobor24
📘 ফেসবুক: Shobkhobor24 Facebook https://www.facebook.com/profile.php?id=61578376864291